মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যাঁরা অস্ত্র হাতে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন কেবল তাঁদেরই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয় তা নয়। সেই সঙ্গে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণ বিতরণসহ যাঁরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছেন তারা, কোলকাতায় স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালকমণ্ডলী, সাংবাদিক, ভাষ্যকার ও শিল্পী, প্রমুখকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাব তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যারা অস্ত্র হাতে মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের চার ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা:
(ক) তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর নিয়মিত সদস্যবৃন্দ। এরা আগে থেকেই অস্ত্র ব্যবহারে এনমকী সম্মুখ সমরাভিযানে প্রশিক্ষিত ছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ‘নিয়মিত বাহিনী’র সদস্য ছিলেন।
(খ) দ্বিতীয়ত: সাধারণ মানুষ যাঁরা বাংলাদশে ত্যাগ করে ভারতে গিয়েছিলেন এবং ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অস্ত্রচালনা, বিস্ফোরকদ্রব্যের ব্যবহার ও গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশলে প্রশিক্ষণ লাভের পর দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করেছিলেন। সংখ্যাই এরাই সর্বার্ধিক। এদের বলা হতো ‘গণবাহিনী’। সামরিক প্রশিক্ষণের পরই এদের হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ।
(গ) টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর আব্দুল কাদেরর সিদ্দীকীর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর লোকজন। এদের অধিকাংশই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের ভেতরই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন; এবং
(ঘ) কেবল ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নতুনভাবে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কিন্তু দেশাভ্যন্তরে না-ফিরে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। এদের পৃথকভাবে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মুজিব বাহিনী’।

জিয়ার রাজাকার বন্ধু সাবেক মন্ত্রী আলীম জেলে




রাজাকার আলীম জেলে, জামিনের শুনানি ৩১ মার্চ 


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তার জামিনের আবেদনের পরবর্তী শুনানি ৩১ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তার স্বাস্থ্যগত দিকে নজর রাখার কথা বলা হয়েছে। সোমবার বেলা দুইটা ৪০ মিনিটে আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইবু্যনাল এ আদেশ দেন।

আবদুল আলীমের আইনজীবী তাজুল ইসলাম ট্রাইবু্যনালে বলেন, 'আটকাদেশের আবেদনে বলা হয়েছে, আলীম বাইরে থাকলে সাক্ষীরা ভীত থাকেন। কিন্তু কোথায়, কখন, কিভাবে কাকে তিনি ভয় দেখিয়েছেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এ সময় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, 'আমি পৌনে ২টার দিকে তার (আলীম) জামিন আবেদন পেয়েছি। এগুলো পড়ে বুঝতে সময় দরকার।
এ সময় ট্রাইবু্যনাল ২টা পর্যনত্ম শুনানি মুলতবি করেন। মুলতবির পর ফের শুনানি শুরম্ন হয়। এ সময় আবদুল আলীমের আইনজীবী তাজুল ইসলাম শুনানিতে অংশ নিয়ে ট্রাইবু্যনালের নির্দেশ মোতাবেক আবদুল আলীমের পক্ষে নতুন করে জামিন আবেদন করেন। এর বিরোধিতা করে প্রসিকিউটর প্রস্তুতির জন্য সময় চান। উভয়পৰের শুনানি শেষে ট্রাইবু্যনাল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আবদুল আলীমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে তার চিকিৎসার জন্য কারা কর্তৃপৰের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। জামিনের উপর পরবর্তী শুনানি ৩১ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে। সকালেই আনা হয় আলীমকে ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার জিয়াউর রহমানের আমলের মন্ত্রী আবদুল আলীমকে সোমবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে আনা হয়। জয়পুরহাট পুলিশের একটি বিশেষ দল আবদুল আলীমকে নিয়ে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইবু্যনাল কার্যালয়ে পেঁৗছে। বিএনপির সাবেক এই সংসদ সদস্যকে রাখা হয় ট্রাইবু্যনাল কার্যালয়ের নিচতলায় হাজত খানায়। জয়পুরহাট পুলিশের একটি দল নীল রঙের মাইক্রোযোগে তাকে আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে আনা হয়। এ সময় তার নিরাপত্তায় পুলিশের বিশেষ দলকে খুবই তৎপরতা দেখায়।
হুইলচেয়ারে আলীম ॥ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত আবদুল আলীমকে গাড়ি থেকে হুইলচেয়ারে হাজতখানায় নেয়া হয়। শুনানির সময় ৭ পুলিশ হুইলচেয়ার উঁচু করে দ্বিতীয় তলায় এজলাসে নিয়ে যায়। এ সময় আবদুল আলীমের লুঙ্গি ও ফতুয়া পরা অবস্থায় ছিল। হাতে ছিল ক্রাচ। ট্রাইবু্যনালে অবস্থান করা পর্যনত্ম খুবই স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। একাত্তরের সময় এই যুদ্ধাপরাধীকে এক নজর দেখার জন্য সাংবাদিক, আইনজীবীসহ ট্রাইবু্যনালের অনেককেই উৎসুক দেখা গেছে।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে আদালত ২টা পর্যনত্ম শুনানি মুলতবি করেছিলেন। তখন ট্রাইবু্যনাল আলীমের আইনজীবীকে নতুন জামিন আবেদন জমা দিতে বলেন। একই সঙ্গে প্রসিকিউশনকে আলীমের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ-সংক্রানত্ম অনুলিপি সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল। সকাল ১০টা ৩৪ মিনিটে আবদুল আলীমকে এজলাসে নিয়ে আসা হয়। হাতে ক্রাচ ও পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি এজলাসে আসেন। ১০টা ৩৬ মিনিটে বিচারকরা এজলাসে আসেন। শুনানিতে অংশ নিয়ে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, 'ট্রাইবু্যনালের নির্দেশ তামিল করা হয়েছে। তাঁকে হাজির করা হয়েছে। তাঁকে আটক রাখা না হলে তদনত্মকাজ বিঘি্নত হবে।' তিনি তাঁকে আটক রাখার আবেদন জানান।
অকাট্য অভিযোগ ॥ আবদুল আলীম মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া জয়পুরহাট জেলার শানত্মি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আলীমের নারকীয় তৎপরতা সম্পর্কে আরও জানা যায়, আবদুল আলীম সেই সময় নিজের হাতে বাঙালীদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল। এছাড়া বেয়নেট চার্জ করে বহু বাঙালীকে মারার অভিযোগ রয়েছে তার বিরম্নদ্ধে। জয়পুরহাটের শহীদ ডা. আবুল কাশেমের পুত্র ডা. নজরম্নল ইসলাম গণতদনত্ম কমিশনকে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই রাতে আবদুল আলীমের নির্দেশে জয়পুরহাট শহরের নিজ বাসা থেকে তার পিতা ডা. আবুল কাশেমকে পাকিসত্মানী বাহিনী ও রাজাকাররা বাড়ি ঘেরাও করে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। সে রাতে তারা জয়পুরহাট স্টেশনে আবুল কাশের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ২৬ জুলাই সন্ধ্যা ৭টায় আবদুল আলীমের নির্দেশে ডা. আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া আবদুল আলীমের বিরম্নদ্ধে হত্যা নির্যাতন অগি্নসংযোগ, ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। জামায়াত নেতা আব্বাস আলী খান ও আবদুল আলীমের নির্দেশে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিসত্মানী সৈন্যরা কড়ইকাদিরপুর গ্রামের হিন্দু এলাকা ঘেরাও করে ১৬৫ জন নিরীহ নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে। পরবর্তীতে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। আলীম তার সহযোগীরা জয়পুরহাটের মঙ্গলবাড়ী গ্রাম থেকে ২৬ মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে হত্যা করে।
ট্রাইবু্যনালে শুনানিতে
গ্রেফতারের পর বিএনপির সাবেক এ সংসদ সদস্যকে সোমবার ট্রাইবু্যনালে হাজির করা হয়। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ১৯৭১ সালে আলীমের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে তাঁর আটকাদেশ চান। এরপর আলীমের আইনজীবী তাজুল ইসলাম এ আবেদনের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। আলীমের আইনজীবী তাজুল ইসলাম আদালতকে বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আসামির বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ গত দেড় বছর ধরেই তাকে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আবদুল আলীমের বিরম্নদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে ১০ হাজার মানুষকে হত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে। অথচ কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এ পর্যায়ে ট্রাইবু্যনাল প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান, ওই ১০ হাজার মানুষ আবদুল আলীম কি একাই হত্যা করেছে। প্রসিকিউটর জানান, তার নেতৃত্বে হত্যা করা হয়েছে। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আবদুল আলীমকে আটক রাখার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ট্রাইবু্যনালের আদেশ তামিল হয়েছে। আসামিকে আটক রাখা না হলে তদন্ত কাজ বিঘি্নত হবে।
প্রসিকিউটরের ব্রিফিং ॥ শুনানি শেষে প্রসিকিউটর এবং আবদুল আলীমের আইনজীবী সাংবাদিকদের উদ্দেশে ব্রিফিং প্রদান করেন। চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনাল দু'পৰের শুনানি শুনেছেন। আসামি পৰ যে দরখাসত্ম দিয়েছে, তা যথার্থ ছিল না। সংশোধন প্রয়োজন। বাদী পৰ থেকে বলা হয়েছে আসামি পৰ যে সমসত্ম কপি দিয়েছে, তা পড়ার অযোগ্য। হাতে লেখা। ট্রাইবু্যনাল উভয়পৰের কথা শুনে আসামি আবদুল আলীমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তার চিকিৎসার বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আসামি পৰ থেকে শর্ত সাপেৰে জামিনের আবেদন করেছে। তার বয়স আশির উর্ধে। এ প্রসঙ্গে চীফ প্রসিকিউটর বলেন, আবদুল আলীম দু'দুবার মন্ত্রী ছিলেন। কয়েকবার এমপি ছিলেন। জয়পুরহাটে তিনি একজন প্রভাবশালী নেতা। বাইরে থাকলে সাৰীরা ভয়ভীতিতে এগিয়ে আসতে পারবে না। সে জন্য তার জামিনের বিরোধিতা করেছি। অন্যদিকে আবদুল আলীমের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, আবদুল আলীমের বয়স ৮২ বছরেরও বেশি। তিনি বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রানত্ম। ৩০ মিনিট পর পর তাকে বাথরম্নমে যেতে হয়। তাই আমরা তার জামিনের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইবু্যনাল জামিন না দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২৩ মার্চ আবেদন
যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিবার ট্রাইবু্যনালের আদেশের পর জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। আলীমকে গ্রেফতারের আগে ২৩ মার্চ ট্রাইবু্যনালে আবেদন করেছিল যুদ্ধাপরাধ তদনত্ম সংস্থা। আলীমের আগে একই অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে আছেন বিএনপির সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তাকে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর অন্য একটি মামলায় আটকের তিনদিন পর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী (দেলু) মোহাম্মদ কামারম্নজ্জামন, আবদুল কাদের মোলস্না কারাগারে আটক রয়েছেন।


একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তাঁকে ওই দিন সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আটক রাখতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন এবং জামিন দেওয়ার জন্য বিএনপি নেতার আইনজীবীর আবেদনের শুনানি ওই দিন পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

গতকাল সোমবার বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল এ আদেশ দেন। এর আগে গত রবিবার এ ট্রাইব্যুনাল আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় পুলিশ ওই দিন রাত ৯টায় জয়পুরহাটের বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার এবং গতকাল সকাল পৌনে ৯টায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করে। রাষ্ট্রপক্ষ আবদুল আলীমকে আটকের নির্দেশনা চেয়ে ২৩ মার্চ আবেদন করে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন আবদুল আলীম।
গতকাল ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়, এটা সত্য যে তিনি (আবদুল আলীম) একজন বৃদ্ধ। তাঁর বয়স ৮০ বছরের বেশি। কারাগারে আটক থাকাবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষ আবদুল আলীমের শারীরিক অবস্থা দেখাশোনা করবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেবে।
আদেশের পর আবদুল আলীমের আইনজীবীর উদ্দেশে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, 'আপনারা তাঁর (আবদুল আলীম) জামিন চেয়েছেন। কিন্তু তাঁকে জামিন দিলে জয়পুরহাটে যেতে দেওয়া হবে না। ঢাকায় থাকতে হবে, যাতে প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দেওয়ামাত্র তাঁকে হাজির করা যায়। এ জন্য ঢাকায় তাঁর এমন কোনো আত্মীয় আছেন কি না যাঁর বাসায় তাঁকে রাখা যায়। আগে থেকে বাসার ঠিকানা দিতে হবে। দেখতে হবে ওই বাসায় রাখার পরিবেশ আছে কি না।' এর আগে সকালে তাঁকে হুইল চেয়ারে করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। প্রথমে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় এবং পরে কাঠগড়ায় তোলা হয়।
এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
গতকাল সকালে আবদুল আলীমকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আবেদনটি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। তিনি আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, 'তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি। মুক্ত থাকলে তদন্তে বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তাঁর ভয়ে সাক্ষীরা ভীতসন্ত্রস্ত হবে।'
এরপর আবদুল আলীমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, 'আটকাদেশের আবেদনে বলা হয়েছে, আলীম বাইরে থাকলে সাক্ষীরা ভীত থাকেন। কিন্তু কোথায়, কখন, কিভাবে কাকে তিনি ভয় দেখিয়েছেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়া আটকাদেশের আবেদনের কোনো কপি পাইনি।' তিনি আটকাদেশের আবেদনের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল শুনানি দুপুর ২টা পর্যন্ত মুলতবি করেন।
দুপুর ২টায় তাজুল ইসলাম জামিনের আবেদন উপস্থাপন করে বলেন, 'আবদুল আলীম একজন বৃদ্ধ। তিনি জয়পুরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হিন্দু পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। যেকোনো শর্তে তাঁর জামিন চাই।'
প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, 'আমি পৌনে ২টার দিকে তাঁর (আলীম) জামিন আবেদন পেয়েছি। এগুলো পড়ে বুঝতে এবং প্রস্তুতির জন্য সময় দরকার।' উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদেশ দেওয়া হয়। এর পর আবদুল আলীমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দল শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা বা সরাসরি খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগি্নসংযোগসহ সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল। আলীম ছিলেন জয়পুরহাট শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর নেতৃত্বে জয়পুরহাটে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের পাশাপাশি আলীম ও তাঁর সহযোগীরা জয়পুরহাট দিয়ে সীমান্ত অতিক্রমের সময় প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের চর আখ্যায়িত করে আবদুল আলীমের নেতৃত্বে তাঁদের হত্যা করে আক্কেলপুর মাদ্রাসার পাশে একটি কূপে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। অনেক লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই আবদুল আলীম ডা. আবুল কাশেমকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের দিয়ে হত্যা করান। আলীমের বিরুদ্ধে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত বছর ২৫ মার্চ তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী প্যানেল ও ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীদের মদদ দিয়ে মাঠে নামাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এনজিও ও বিভিন্ন ইসলামী নামের সংগঠন। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। শনিবার রাজধানীতে গ্রেফতার হওয়া ১৭ শিবির ও জঙ্গীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
শনিবার ঢাকার কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে জড়ো হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে মিছিল করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় গ্রেফতার হয় ১৭ শিবির-জঙ্গী। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে জড়ো হয়ে অর্ধশতাধিক শিবির ও জঙ্গী যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে সেস্নাগানসহ মিছিল করার সময় পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ বেধে যায়। শিবির ও জঙ্গীরা ভাংচুর, লুটপাট ও পুলিশকে লৰ্য করে ইটপাটকেল নিৰেপ করার সময় ১৭ শিবির ও জঙ্গীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল ছাড়াও জঙ্গীদের সংগঠিত করে রাজধানী ঢাকা-ঢাকার বাইরে বড় ধরনের নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর নীল-নকশার কথা জানতে পেরেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারের পর তাদের মুক্তির দাবিতে নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামানো খোদ ঢাকা থেকেই অনত্মত ৪০ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে শক্তিশালী বোমা। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, বিভিন্নস্থানে যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীদের নিয়ে জামায়াত ক্যাডাররা ব্যাপক বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা ও স্পর্শকাতর স্থানে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজধানীর আরামবাগের জামায়াত-শিবিরের মেসের পাশ থেকে র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪টি শক্তিশালী হাত বোমা উদ্ধার করেছে। মতিঝিল থানায় এই ব্যাপারে বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। কুষ্টিয়ায় দুই জামায়াত নেতাকে শক্তিশালী হাতবোমাসহ গ্রেফতার করা হয়।
জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা এর আগে গত বছর পল্টন ও কাকরাইল এলাকায় জঙ্গী মিছিল বের করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল দিয়ে চোরাগুপ্তা হামলা চালায় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশ ১১ জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ১১ জামায়াত_শিবির ও জঙ্গী সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা গুরম্নত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়।
গত বছর গ্রেফতার করা হয় ২৫ জামায়াত_শিবির ও জঙ্গীকে। জামায়াতের পলাতক সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুলস্নাহ মোহাম্মদ তাহের নির্দেশ ও উস্কানি দিয়ে মাঠে নামায় তাদের। যুদ্ধাপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল ও আটক শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মুক্তির জন্য নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। জামায়াত_শিবিরের গ্রেফতারকৃত ২৫ কর্মী-ক্যাডারকে জিজ্ঞাসাবাদ, অনুসন্ধান ও তদনত্মে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ এবং গোয়েন্দারা। জামায়াতের সাবেক এমপি ডা. আবদুলস্নাহ তাহের জাতীয় প্রেসক্লাবে গত ৪ আগস্ট গোলটেবিল বৈঠকে বলেছিলেন, তাদের রিজার্ভ ফোর্স রেডি আছে। যে কোন সময়ে তারা মাঠে নামবে। তারপর জামায়াত_শিবিরের ২৫ ক্যাডার একত্রিত হয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নেয়ার সময়ে গ্রেফতার হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দারা পলাতক জামায়ায় নেতার বক্তব্যের সঙ্গে গ্রেফতারকৃতদের মাঠে নামার সম্পৃক্ততার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে।
এর আগে রাজধানীর শাহআলী থানাধীন উত্তর বিশালের বাড়ি থেকে জঙ্গী ও জামায়াত_শিবির ক্যাডারদের আসত্মানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য ও জিহাদী বই। গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার রতনপুর থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবদুলস্নাহ জায়েদ বিন ছাবিদকে গ্রেফতার করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, জামায়াত_শিবির সংগঠিত হয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। অস্ত্র ও গোলাবারম্নদ মজুদের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা ও পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, জামায়াতের সাবেক এমপি ডা. তাহের ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতিকে গ্রেফতারের জন্য মগবাজার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিসে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়। তাদের গ্রেফতার করা যায়নি। আত্মগোপনে থেকে তারা যুদ্ধাপরাধী, শিবির ও জঙ্গীদের সংগঠিত করে নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর উস্কানি ও নির্দেশ দিচ্ছে। জামায়াত_শিবিরের রিজার্ভ ফোর্সের সদস্যরা এখন নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর কৌশল গ্রহণ করেছে বলে বিভিন্ন সময়ে জামায়াত_শিবির ও জঙ্গী সদস্যরা গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে গুরম্নত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। শনিবার রাজধানী ঢাকার কাকরাইল এলাকায় যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে মিছিল করার সময়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সময় গ্রেফতারকৃত ১৭ জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ১৭ জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর তথ্য পাওয়া গেছে।