১৫ই আগষ্টের পরে পঁচাত্তরের ৩ ও ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ওপর যে অভিঘাত নেমে আসে সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, যে উদ্দেশ্যে করেছিল, তারাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথকে পরিষ্কার করার জন্য ৩ নভেম্বর জেলখানার ভেতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। আরেকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মাঝখানে মাত্র চার দিন পিছু হটে থাকার পর পুনরায় ৭ নভেম্বর তথাকথিত বিপ্লবের নামে ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর যে অভিঘাত নেমে আসে তা থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। আজকে বাংলাদেশে যে চরম রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা, ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং লুটপাটের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অব্যাহত আছে তার মূলে রয়েছে ১৫ আগস্ট এবং তার ধারাবাহিকতায় ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত। ৩ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর অনেক কিছুই এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। ঘটনাগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িতদের মধ্যে অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তারা হয়তো মুখ খুলছেন না। সব সুযোগ ও শক্তি থাকার পরও কেন ৩ নভেম্বর চালিত খালেদ মোশারফের অভিযান ব্যর্থ হলো? কেন জেলখানায় অবস্থিত জাতীয় চার নেতার জীবন রক্ষা করা সম্ভব হলো না? ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থান ছিল সম্পূর্ণ রক্তপাতহীন, একটি মানুষের জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়নি, অথচ জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে পরিস্থিতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এবং বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দারকে কেন ৭ নভেম্বর সকালে নাশতারত অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করল? কার সম্মতিতে বা কার হুকুমে মহান মুক্তিযুদ্ধের এ বীর সেনানিদের হত্যা করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে কেউ হয়তো বলতে পারেন, সময়ের উত্তেজনাবশত এসব ঘটনা ঘটে গেছে। এ রকম যারা ভাবেন তারা কেন ভাবেন না যে, খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সংঘটিত ক্ষণস্থায়ী অভ্যুত্থান ছিল আরও ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ, কিন্তু কই, ওই চার দিনে তো একজন মানুষকেও জীবন দিতে হয়নি। জাতিকে অগ্রায়ণের পথে রাখার জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর ও তার সমাধান প্রয়োজন।
সত্য একদিন বেরোবেই, তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিন পর্যন্ত আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। তাই প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখেই এখন দেখা যাক ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার নেতার হত্যার পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন করা হয়। জেনারেল খালেদ মোশারফ ও কর্নেল জামিলের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর ভোর হতে হতেই রক্তপাতহীন ও নীরব অভ্যুত্থান সম্পন্ন হয়ে যায়। ১৫ আগস্টের পর বঙ্গভবনে জেঁকে বসা খুনি মেজররা সারা দিন দর কষাকষি শেষে ওই দিন সন্ধ্যার পর দেশত্যাগ করে চলে যায়। এ সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ খালেদ মোশারফের ক্যু শুরু হওয়ার প্রথম ধাপেই ২ নভেম্বর রাতে, ৩ নভেম্বরের প্রত্যুষে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, অত্যন্ত নৃশংস ও বর্বরতার সঙ্গে। বঙ্গভবন থেকে প্রথমে মেজর রশিদ এবং দ্বিতীয়বার দেশের স্বয়ং রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এ হত্যাকাণ্ডের অনুমতি দেন, যার বিস্তারিত বিবরণ এন্থনি মাসকারেনহ্যাসের- ‘এ লেগেসি অব ব্লাড’ গ্রন্থের ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে। ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশারফের ক্যু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসালদার মোসলেমউদ্দিন সেনানিবাস থেকে ঘাতকদল নিয়ে জেলখানায় হাজির হয়। খুনি মেজররা তখন ছিল বঙ্গভবনে।
এতে বোঝা যায় জেলহত্যা ছিল ১৫ আগস্টের খুনিদের পূর্ব পরিকল্পিত কন্টিজেন্সি প্ল্যান। অর্থাৎ ১৫ আগস্টের উদ্দেশ্য সামান্যতম হুমকির সম্মুখীন হলে চার নেতাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে, যাতে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো আর কেউ বেঁচে না থাকে। পরিস্থিতির বিশ্লেষণে মনে হয়, ১৫ আগস্টে চার নেতাকে অন্যদের সঙ্গে হত্যা না করে মোশতাক একটা সুযোগ নেওয়ার পথ খোলা রেখেছিলেন, যদি ওই চার নেতাকে দলে ভিড়ানো যায় তাহলে সেটা হতো মোশতাকের জন্য সোনায় সোহাগা। কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টায় তা সম্ভব না হওয়ায় তাদের জেলে ঢোকানো হয়, যাতে সময় সুযোগমতো খুনিরা যে কোনো বিকল্প প্ল্যান কার্যকর করতে পারে। বিভিন্ন সোর্স থেকে ওই সময়ের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, খালেদ মোশারফের ক্যু শুরু হওয়ার প্রায় দুই/তিন ঘণ্টা পর জেলখানায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনাকে বিদায় করে পাকিস্তানের চেতনা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। তাজউদ্দীন ছিলেন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি, যিনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আপসহীনভাবে এগিয়ে নিতে পারতেন। শত্রুরা সেটি ঠিকই বুঝেছিল, তাই দেখা যায় তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর সরকারে তখন ছিলেন না, বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদেও ছিলেন না, তবুও তাকে অন্য তিন নেতার সঙ্গে হত্যা করা হলো। এতেই বোঝা যায়, শত্রুদের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কি ছিল। এ বিষয়ে জেলহত্যা মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়-
‘The conspirators for whom the killers committed this criminal act made their plan so that everything the people of this country fought for and dreamt about would be destroyed’. ১৫ আগস্ট সকালে খুনিদের মধ্যে অন্যতম মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় (এ লেগেসি অব ব্লাড-এন্থনি মাসকারেনহ্যাস, পৃ : ৭৭)। সুতরাং ১৫ আগস্টের মূল ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশকে যে আরেকটি পাকিস্তান স্টাইলের রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল তা কিন্তু খুনিরা একেবারে প্রথমেই ঘোষণা দিয়ে দেয়। আরেকজন বাঙালি, নাম মাহমুদ আলী, বাড়ি সুনামগঞ্জ। তিনি একাত্তর সালে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যকরী সদস্য ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ইউরোপ-আমেরিকা সফর করেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
এহেন মাহমুদ আলী পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর দূত হিসেবে ১৫ আগস্টের পরপরই বিশেষ মিশন নিয়ে লন্ডনে হাজির হন এবং বাংলাদেশের খুনি ও সদ্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক-বেসামরিক অধিকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এন্থনি মাসকারেনহ্যাসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদ আলী বলেন,“I want reunification of Pakistan, This Bangladesh thing must be finished with” (প্রাগুক্ত- পৃঃ ৮৬)। এই মাহমুদ আলীরা বাঙালি হয়ে বাঙালিদের স্বার্থ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং কী রকম ভয়ানক অকৃতজ্ঞ হতে পারেন তার একটি উদাহরণ দিই। মাহমুদ আলী তো পালিয়ে গেলেন ১৬ ডিসেম্বরের আগে, কিন্তু এ দেশে রয়ে গেল তার স্ত্রী ও মেয়ে। এই মেয়ে রত্নটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে অশালীন ভাষায় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। স্বাধীনতার পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা জনতার হাতে তারা লাঞ্ছিত হবেন অথবা কন্যা রত্নটি কোলাবরেটর আইনে জেলে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে কিছুই হতে দিলেন না। পুলিশকে আদেশ দিলেন মাহমুদ আলীর পরিবারের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার। ২০ হাজার টাকা ও পাসপোর্ট দিলেন এবং তাদের গোপনে দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার প্রবল শত্রুর পরিবার-পরিজনের ওপরও কখনো প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেননি (ইতিহাসের রক্তপলাশ- আ. গাফফার চৌ. পৃঃ ৮১)। এহেন মাহমুদ আলী ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে ‘মীরজাফর’ আখ্যা দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর অভিযানে নেমেছিলেন। কিন্তু মাহমুদ আলীরা পরিপূর্ণ সফল হতে পারেনি। তার মূল কারণ ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বাংলাদেশের মাটিতে মিশে আছে। তাই বাংলার এই মাটির একটা প্রবল সহজাত শক্তি আছে। সেই শক্তির প্রত্যাঘাতে মাহমুদ আলীরা কিছুটা পিছু হটার কারণেই আজ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ফাঁসি হচ্ছে।
এবার কিন্তু একটা কাকতালীয় বিষয়ও ঘটে গেছে। জেলহত্যা দিবসে এ বছর ৩ নভেম্বরে একাত্তরের গণহত্যাকারী কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট। অদৃশ্যের লীলা কাকে বলে! ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাতের উদাহরণ কত দেব। লিখে শেষ করা যাবে না, আবার অনেক কিছুর পুনরাবৃত্তি হয়ে যেতে পারে। তবুও আমি মনে করি, নতুন প্রজন্মের জন্য, এ দেশের মানুষের জন্য বারবার আমাদের লিখতে হবে, যতদিন না ১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হচ্ছে। এই যে যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লা এবং গণহত্যাকারী কামারুজ্জামান- এরা দুজনই জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। অথচ প্রেসক্লাব ছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম একটি সূতিকাগার। এখন ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লব সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলে লেখার উপসংহারে চলে যাব। ক্যু ও বিপ্লবের মধ্যে যে পার্থক্য পণ্ডিতেরা করে গেছেন প্রথমেই তার একটু উল্লেখ করতে চাই। A coup is a single act and a revolution is a continuous movement. A coup is an occurrence, a revolution is an era. A coup brings about a change in personnel, a revolution brings about basic change in the structure of the society. In the revolution key role is played by the people, in a coup it is only few military personnel are involved (Elizer Beeri)। কিউবা, রাশিয়া, চীন ও অধুনা ইরানসহ প্রতিটি বিপ্লবের ক্ষেত্রেই একজন বিপ্লবী নেতার নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে।
চূড়ান্ত বিজয়ের আগে বিপ্লবী নেতাদের দেশের বৃহত্তর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নেতা কে ছিলেন? বিপ্লবের জন্য আবশ্যকীয় সেই সংগঠন কোথায় ছিল এবং তাদের সংগ্রামেরই বা স্বরূপ কেমন? যারা ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করেন তারা অতি ধূর্ততার সঙ্গে এ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলেন। বিপ্লব থাকে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল। সেখানে বিপ্লবী দলের কোনো ব্যক্তি বা সৈনিক লক্ষ্যহীন ও শৃঙ্খলচ্যুতের কাজ করলে নিজের কমরেডদের হাতে পেতে হয় চরম শাস্তি। ৭ নভেম্বরের পরের দিন ৮ নভেম্বর উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকরা ২৪ জন নিরীহ অফিসারকে হত্যা করল। এর দায় কার ওপর বর্তাবে? নিরীহ অফিসারদের যারা হত্যা করল, কই তাদের বিচার তো ওই বিপ্লবের তথাকথিত নেতারা কেউ করলেন না। আর সংহতির কথা বললে তো বলতে হয় সংহতি হওয়ার কথা ছিল জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহেরের মধ্যে। কারণ ৭ নভেম্বরের উদ্যোক্তা ছিলেন কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন জাসদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু কর্নেল তাহেরের অস্থিরতা এবং জিয়াকে বুঝতে ভুল করায় উল্টো ঘটনা ঘটে যায়। ৭ নভেম্বর সকালে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের সাক্ষাৎ হওয়ার আগে একাত্তরের পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তির কব্জায় চলে যায় জিয়াউর রহমান। ওই ঘোলাটে অবস্থায় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অতি মূল্যবান। কর্নেল তাহেরের সেই ভুলের জন্য মাত্র সাড়ে আট মাসের মাথায় একটি প্রহসনের বিচারে তাকে প্রাণ দিতে হয়। শুধু ঢাকা শহরের রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও সেনাবাহিনীর কয়েকটি লরির ওপর পাকিস্তানের আইএসআই কর্তৃক প্ররোচিত কিছু লোকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেওয়াকে আর যাই হোক বিপ্লব বলা যায় না। প্রকৃত অর্থে বিপ্লব বলতে যা বোঝায়, ৭ নভেম্বর যদি সেটাই হতো তাহলে সারা দেশের জনগণের সেই বিপ্লবে অংশগ্রহণ থাকত। তাদের স্লোগান হতো জনকল্যাণের স্লোগান, তা হতো নির্যাতিত মানুষের মুক্তির স্লোগান এবং হতো বিপ্লবের প্রকৃত আদর্শের ধারাতে। সেখানে একাত্তরের বিতাড়িত জিন্দাবাদ স্লোগান ওঠত না। বিপ্লবের একটি আদর্শ ও দর্শন থাকে, যার দিকে মানুষকে আকর্ষিত করার জন্য বিপ্লবী সংগঠন ও নেতাদের কঠিন ও দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়। নেতাদের ত্যাগের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভেতর আস্থা সৃষ্টি করতে হয়। মানুষ তখন শুধু আদর্শের জন্য, ব্যক্তিগত কিছু পাওয়ার জন্য নয়, নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দল বেঁধে এগিয়ে আসে। সেই এগিয়ে আসা জনস্রোতকে কোনো শক্তিই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যার উদাহরণ আমরা দেখেছি রাশিয়া, চীন, কিউবা ও ইরানের বিপ্লবসহ ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর।
এক রাতের মধ্যে বা দু-এক সপ্তাহের বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনার মাধ্যমে বিপ্লব হয় না। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর কোনো বিপ্লব হয়নি, ওটা ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর চরম অভিঘাত। এই অভিঘাতের ফলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতসহ উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশে। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিলে সেই রাজনীতিক দলের কি অবস্থা হয় তা এখন বোঝা যাচ্ছে। কারণ আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বেরোবার পর বিএনপির মতো এতবড় একটি দলকে মুখ বুঁজে থাকতে হচ্ছে, এদিক-ওদিক কোনো কিছুই বলতে পারছে না। ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে আজ বড় অন্তরায় হলো, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সুশীল সমাজসহ সর্বক্ষেত্রে ৩ ও ৭ নভেম্বরের অভিঘাতের ফলে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণির শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা যদি সত্য হয়, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে অভিঘাত মুক্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তার পরিপূর্ণ জয় একদিন হবেই।
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।